অঅ-অ+
প্রথম বিশ্বকাপ দেখব, কাভার করব। কবি-মন থাকলে ভেতরকার উন্মাদনার প্রকাশটা কাব্যিক হতো। সাধারণ সাংবাদিকের বর্ণনায় এই ব্রাজিল বিশ্বকাপ কেবল ফুটবলের সর্বোচ্চ রোমাঞ্চ। ফুটবলতীর্থে গিয়ে দেহ-মনের ফুটবল অবগাহনে ডুবে থাকার রোমাঞ্চ। সঙ্গে এবার আরেকটা বিষয়ও ছিল, ফুটবল সৌন্দর্যের চিরকালীন লড়াইটা প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হবে মারাকানায়। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ফাইনালে মুখোমুখিতে তীর্থ যাবে মহাতীর্থের পথে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান ও সাধারণের বিশ্বাস মেনে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত সে পথেই ছিল। পথ বেঁকে গেছে সেমিফাইনালে, স্বভূমিতে সেলেসাও সৌন্দর্য প্রবল কম্পনে ধরাশায়ী। নান্দনিক ফুটবলের চিরকালীন ঠিকাদাররা পথভ্রষ্ট হয়েছে বলেই কিনা কে জানে, তবে জার্মান বুলডোজারে দফারফা হয়ে গেছে ব্রাজিলের ফুটবলের। আর্জেন্টিনা অবশ্য কক্ষপথেই আছে, প্রজন্মের মহান শিল্পী লিওনেল মেসির শিল্পিত ফুটবল যেন অমরত্বের দিকে রওনা দিয়েছে। একদিকে সৌন্দর্যের বুক চিড়ে ফুটবল-দানবের উন্মেষে কথিত স্বপ্নের দিকে হাঁটেনি ফাইনাল। নতুন চেহারা নিয়ে তা হয়েছে এখন সুন্দর বনাম শৌর্যের লড়াই।
তবে জার্মানভক্তরা আপত্তি তুলতে পারেন ‘দানব’ শব্দে। হ্যাঁ, অধুনা জার্মান ফুটবলকে আর পুরোপুরি ‘রোবটিক’ বলা যাবে না। গার্দিওয়ালার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বায়ার্ন মিউনিখ পাল্টেছে আর পরোক্ষে জার্মান ফুটবলও যেন চরিত্র বদলাচ্ছে। এর পরও জার্মান সৌন্দর্য বলতে একটু বাধো বাধো লাগে, শিল্পী যেটা অনেক কসরত করে আদায় করে নেয়, সেটা তারা করে নির্মম নিষ্ঠুরতায়। এবং অবশ্যই অতি সহজে। যেমন পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের জালে তারা সাত গোল করেছে, যেন ফুটবলে গোলের
মতো সহজ কাজ আর হয় না! মেসি-ম্যারাডোনা এক দলে খেললেও সেলেসাওদের এভাবে লজ্জায় ফেলতে
পারতেন কিনা সন্দেহ। প্রখ্যাত ফুটবল লেখক প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এক লাইনে বিষয়টার দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন,
‘লাতিনের লোকজন যেটা করে, খুব আনন্দ নিয়ে করে এবং উপভোগও করে। জার্মানরা জানে কিভাবে সফল হতে
হয় এবং যা করে সাফল্যের জন্যই করে।’ জার্মানরা ভাবের পাগল নয়, তারা কর্মবীর- চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতা,
শৃঙ্খলাপরায়ণতা ও প্রতিজ্ঞায় খেলাটাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে সেখানে বিনোদন বলে কিছু নেই। সাফল্যই
এই জার্মানি কিন্তু ভালো খেলছে। তাদের বড় সুবিধার দিক হলো, সাফল্যের জন্য কোনো বিশেষ ফুটবলারের দিকে
চেয়ে থাকতে হয় না।
এক দশকের ফুটবল একাডেমি চর্চার সুফল হিসেবে পেয়েছে লাম, শোয়াইনস্টাইগার, গোৎজের মতো
প্রতিভাবানদের। কোনো ঘাটতি নেই কোনো পজিশনে। জার্মান ফুটবলকে অনেক দিন ধরে কাছ থেকে দেখা কোচ
ইওয়াখিম ল্যোভের চোখে ‘এটাই সেরা দল’। কেন সেরা সেটাও মাঠে প্রমাণ করে দিয়েছে স্বাগতিক ব্রাজিলকে
সেমিফাইনালে ৭-১ গোলে হারিয়ে। এমন মসৃণ গতিতে এগিয়েছে, ‘বুড়ো’ ক্লোজেও বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের
রেকর্ড গড়েছেন আর তরুণ থোমাস ম্যুলার ছয় ম্যাচ ৫ গোল করে দলের সবচেয়ে সফল ‘বুলডোজার’। তাই এই
নিখুঁত দলটি এরই মধ্যে বিশ্বজয়ীর চেহারা নিয়ে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। তাই ফাইনালে তাদের
পিছিয়ে রাখার ঝুঁকি কেউ নিতে চাইছেন না।
কিন্তু কেউ কেউ নিচ্ছেন। যাঁরা শিল্পের পূজারি, বিশ্বকাপের মহামঞ্চে প্রথাগত শক্তির বিরুদ্ধে শিল্পিত ফুটবলের
আলোড়ন প্রত্যাশী তাঁরা এগিয়ে রাখছেন মেসির আর্জেন্টিনাকে। গোলের হিসাবে ম্যুলারের চেয়ে পিছিয়ে লিওনেল
মেসি। ওই জার্মান ফরোয়ার্ডও টুইটারে বলছেন, মেসি কখনো তাঁর বিপক্ষে জেতেনি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে।
সেটা আরো নিশ্চিত করতে এই আর্জেন্টাইনকে রুখে দেওয়ার গোপন কৌশলের কাজও তারা সেরে ফেলেছে। কিন্তু
সব প্রতিরোধ-প্রতিকূলতায় যে শিল্পী মনের আর্গল খুলে দেয়। প্রতিরোধ না থাকলে শিল্পের মহিমাই বা কোথায়?
তাই মেসির জাদুকরী পায়ে যে কল্পনাকে চুরি করে সবুজ ঘাসের বুকে ফুটবলের নতুন শিল্পকর্ম হবে না, মানুষের
হৃদয় দোলা দেবে না তা বলা কঠিন। চারবারের বিশ্বসেরা বিশ্বকাপের শুরুতে নিজের গোলের গেরো খুলে নিয়েছেন,
চার গোল করে আর্জেন্টিনাকে গ্রুপ উতরে দিয়ে দলের পরীক্ষা নিয়েছেন। দলের চেহারা ভালো হয়েছে, লাভেজ্জি-
মাসচেরানোরা তাঁকে আশ্বস্ত করছেন। তার পরও ফাইনালটা যখন সেরা দলের সঙ্গে, তখন জাদুকরই
আর্জেন্টিনার স্বপ্নের বাহক।
ম্যারাডোনা যুগের উপহার হিসেবে আর্জেন্টিনা ’৮৬ বিশ্বকাপ জিতেছিল মেক্সিকোতে। সেই দ্বিতীয় শিরোপা পরের
বিশ্বকাপেই হাতছাড়া হয়েছিল এই জার্মানির কাছে, ফাইনাল হেরেছিল ব্রেমের গোলে। এর ২৪ বছর পর লিওনেল
মেসির সামনে প্রতিশোধের মঞ্চ তৈরি। প্রতিপক্ষ জার্মানি ভালো খেলছে, তবে টুর্নামেন্টে বাজে দিনের মুখোমুখি
হয়নি এখনো। সাম্প্রতিক অতীত বলছে, শিরোপার খুব কাছে গিয়েই সেই দিনটি দেখে তারা। ২০০৬ বিশ্বকাপ
থেকেই শুরু হয়েছে এই হতাশার অধ্যায়, কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে টাইব্রেকারে হারিয়ে তারা ইতালির
কাছে হেরে ২-০ গোলে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। দুই বছর বাদে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তুরস্ককে
হারিয়ে তারা ফাইনালে উঠে স্পেনের কাছে হারে ০-১ গোলে। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে সেই স্পেনের কাছে ১-০
গোলে হেরে সেমিফাইনালে তাদের অভিযান শেষ। দুই বছর পর ইউরোতেও ইতালির কাছে ২-১ গোলে হেরে
আটকা পড়ে সেমিফাইনালে। জার্মানির গত আট বছরের ইতিহাসের গেরোটাই হতে পারে আর্জেন্টিনার বাড়তি
প্রেরণা।
তবে তার আগে, অর্থাৎ এই ফাইনালের আগে ডিয়েগো ম্যারাডোনার একবার তিলকারা (tilcara) গ্রামে গিয়ে
‘শাপমোচন’ করে আসা উচিত ছিল। আর্জেন্টিনার এই গ্রামে ’৮৬ বিশ্বকাপের দলের ট্রেনিং হয়েছিল। তখনকার
কোচ কার্লোস বিলার্দো এক দিন পুরো দল নিয়ে গ্রামের ‘ভর্জিন মেরি’র গির্জায় গিয়েছিলেন প্রার্থনা করতে। বলে
এসেছিলেন, শিরোপা জিতলে কাপ নিয়ে আবার সদলবলে গির্জায় ফিরবেন। কিন্তু গত ২৮ বছরেও তাঁরা কেউ
যাননি। গ্রামের মানুষের কাছে এই গির্জার ‘কুমারী মেরি’ খুবই জাগ্রত, তার কাছে গিয়ে মানত করলে ফল পাওয়া
যায়। তাঁদের ধারণা, ’৮৬-র দলের কথা দিয়ে কথা না রাখার জের টানছে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল!
সেই বিলার্দো-ম্যারাডোনার পাপ কি মেসিকেও টানবে নাকি আট বছরের ওই হতাশা আরো প্রলম্বিত হয়ে
পেশাদার জার্মানি হয়ে উঠবে অধুনা ‘চোকার’। এই রহস্যের কিনারা করবে কিংবদন্তি মারাকানা!
No comments :
Post a Comment