আসসালামু আলাইকুম

SSC পরিক্ষার্থীরা সুন্দরভাবে পরিক্ষা দিন এর জন্য আমি দোয়া করছি। সেই সাথে আমার ব্লগে ভিজিট করার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ।

Jul 3, 2014

কে, কাকে, কখন, কীভাবে যাকাত আদায় করবে...


যাকাত ইসলামের অন্যতম মৌলিক একটি ইবাদত। যাকাত একজন মুসলমানের সম্পদকে, অর্থকে বিশুদ্ধ-পরিশুদ্ধ করে। আমরা যেমন ময়লা পরিষ্কার করার জন্য গোসল করি, পরিধেয় কাপড় পরিষ্কার করার জন্য যেমন ডিটারজেন্ট দিয়ে কাপড় ধুই, তেমনি জাকাত একজন মানুষের সম্পদকে পরিষ্কার করে। নতুবা সম্পদ সাপ-বিচ্ছু হয়ে আখেরাতে দংশন করবে।
যাকাত কি:
যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র করা, পরিশুদ্ধ করা বা প্রবৃদ্ধি দান করা। শরিয়তের ভাষায়, সুনির্ধারিত সম্পদ সুনির্ধারিত শর্তে তার হকদারকে অর্পণ করা। এক কথায় কোনো মুসলমান আল্লাহ নির্ধারিত (নিসাব) পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে এবং তা এক বছর পর্যন্ত তার কাছে থাকলে তার নির্ধারিত পরিমাণ অংশ হকদারের কাছে পৌঁছে দেয়াকে যাকাত বলা হয়।

কোরআন-হাদীসে যাকাত:
পবিত্র কুরআনের বহুসংখ্যক আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর যাকাতএর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, এর বিধান, আদেশ, রহমত, অধিকার, প্রাপক ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েকটি আয়াত উল্ল্যেখ করা হলোঃ
বিধান: এবং সালাত কায়েম করবে আর যাকাত প্রদান করবে, এই হচেছ দীনের মজবুত বিধান।-[বাইয়্যেনাহঃ৫]
আদেশ: তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত দাও।- [বাকারাহঃ ৪৩ ও ১১০]
রহমত: সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে করে তোমরা আল্লাহ্র রহমত পেতে পার। -[নূরঃ ৫৬]
অধিকার: তাদের ধন-সম্পদে সুনির্দিষ্ট অধিকার আছে ভিখারী ও বঞ্চিতদের জন্য। -[আল-মাআরিজঃ ২৪ ও ২৫]
প্রাপক: যাকাত কেবল ফকির মিসকিন ও তৎসংশ্লিষ্ঠ কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষন করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋনে জর্জরিত ব্যক্তিদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। -[তওবাঃ ৬০]
পবিত্রতা: তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত ) গ্রহন করুন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র , করবেন এবং পরিশোধিত করবেন । -[তওবাঃ ১০৩]
ধন সম্পদ বৃদ্ধি: আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাকো তাহাই বৃদ্ধি পায় এবং উহাই সমৃদ্ধশালী। -[রোমঃ ৩৯]
ধন সম্পদ ধ্বংস: দুর্ভোগ (ধংস ) অনিবার্য ঐ সকল মুশরিকদের জন্য যারা যাকাত আদায় করে না এবং আখিরাতেও অবিশ্বাসী।–[ হামিমঃ ৬ ও ৭]
হুশিয়ার: আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপনতা করে, তাদের জন্য তা মঙ্গল এ যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। -[আল-ইমরানঃ ১৮০]
বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (স) বলেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। নামাজ কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রোজা রাখবে, হজ করবে আর সঙ্ঘবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে, তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
যে যাকাত আদায় করে না তার কোন সালাত কবুল হয়না। -[তাফসীরে তাবারী]
স্থল ও জল ভাগে যে ধন-সস্পদ নষ্ট হয় তা শুধু যাকাত বন্ধ করার দরুন।–[বায়হাকী,তাবরানী]
যাকাত যে মালের সাথে মিশ্রিত হয় সে মালকে যাকাত অবশ্যই ধ্বংশ করে দেয়।–[বাজ্জার,বায়হাকী]
এসব হাদীস ও আয়াতের আলোকে যাকাত ইসলামের অন্যতম অপরিহার্য ফরয দায়িত্ব বলে প্রমাণিত হয়।
যাকাত কখন ফরয হয়:
নিত্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সাড়ে ৭ তোলা সোনা বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা বা সমমানের নগদ অর্থ /সম্পদের মালিক হলে, এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে-বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কের ওপর যাকাত ফরজ হয়।। এ হিসাবটাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নেসাব বলে। অতএব, কারো যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে।এ বছর (২০১৪ সালে) রূপার বাজার দাম হিসাবে এ পরিমাণ হলো প্রায় ৩২ হাজার টাকা।
কোন কোন সম্পদে যাকাত আসে:
>>নগদ টাকা-পয়সা, ব্যাংক ব্যালেন্স, বন্ড ও অন্যান্য ফাইন্যানশিয়াল ইন্সট্রুমেন্টস
>>সোনা-রূপা; অর্নামেন্ট, বার যা-ই হোক; তা নিত্যব্যবহার্য হলেও।
>>ব্যবসার সম্পদ; যা ব্যবসার উদ্দেশে ক্রয়কৃত; কিংবা ব্যবহারের উদ্দেশে ক্রয়ের পর বিক্রয়কৃত।
>>ব্যবসার কাঁচামাল, উৎপাদিত বস্তু, বা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা বস্তু। শেয়ারও এ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত।
>>অন্যান্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদ।
কাকে যাকাত দেয়া যাবে:
দরিদ্র: এমন মজুর ও শ্রমজীবী যে শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে বেকার ও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। ছিন্নমূল মানুষ এবং শরণার্থীরাও এর মধ্যে পড়েন।
অক্ষম: বার্ধক্য, রোগ, বা পঙ্গুত্ব যাকে উপার্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে অথবা যে ব্যক্তি উপার্জন দ্বারা তার প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ করতে অক্ষম এবং আশ্রয়হীন শিশু প্রমুখ।
যাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী: যাকাত আদায় এবং তা বণ্টন করার কাজে যারা সার্বক্ষণিক নিযুক্ত থাকবে তাদের বেতন-ভাতা আদায়কৃত যাকাত থেকে দেয়া হবে।
ইসলামের প্রতি বিধর্মীদিগকে আকৃষ্ট করার প্রয়োজনে: ইসলাম প্রচার-কাজ কোথাও প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে সে ক্ষেত্রে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। সংগতিহীন নও মুসলিমকেও স্বনির্ভর করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় হতে পারে।
মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্যে: দাসমুক্তি বা বন্দিদের মুক্ত করতে যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা যাবে। এখানে দাস বা বন্দি বলতে বিখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা আসআদের তাফসীরে যারা পরিস্থিতি বা পরিবেশের বন্দি বা শিকার তাদের কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভূ-লুণ্ঠিত, অপরিচিত, দুর্গম-দূরবর্তী অভাবগ্রস্ত এলাকার দুস্থ-অসহায়দেরও যাকাত দেয়া যাবে।
ঋণমুক্তি: যারা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে ঋণ করে এবং সে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের সম্পদ হতে সাহায্য করা যাবে। যাদের বাড়ি-ঘর আগুনে পুড়ে গেছে, বন্যা-প্লাবনে মাল-আসবাব ভেসে গেছে, তাদের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণে যাকাতের সম্পদ দেয়া যাবে।
আল্লাহর পথে (জনকল্যাণমূলক কাজ, ধর্মপ্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে): যাকাতের ৭ম খাত হলো 'ফি সাবী লিল্লাহ' (আল্লাহর পথে)।
ইসলামি চিন্তাবিদগণের সম্মিলিত মত হলো: আল্লাহ নির্দেশিত পথে প্রতিটি জনকল্যাণকর কাজে, দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যত কাজ করা সম্ভব সেসব ক্ষেত্রেই এ অর্থ ব্যয় করা যাবে।
মুসাফির: যাকাতের ৮ম খাত হলো 'ইবনুস সাবীল' (নিঃস্ব পথিকদের জন্যে)। যেসব পথিক বা মুসাফির যাত্রাপথে নি:সম্বল হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে।
যাদের যাকাত দেয়া যাবে না:
>>ঔরসজাত সম্পর্ক। যেমন- পিতা ছেলেকে, বা ছেলে পিতাকে।
>>বৈবাহিক সম্পর্ক। যেমন- স্বামী স্ত্রীকে, বা স্ত্রী স্বামী।
পরিজনদের ক্ষেত্রে কোরআন এবং হাদীসে যাকাত নয়, সদকা দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। নবীজী স. বলেন, উত্তম সদকা হচ্ছে নিজের পরিবারের ও আত্মীয়দের জন্যে ব্যয়।
যাকাত বিষয়ক কিছু জরুরী জ্ঞাতব্য:
>> নিয়ত না করে নিজের সকল সম্পদ দান করলেও যাকাত আদায় হবে না।যাকাতের ক্ষেত্রে নিয়ত করা (যাকাত দিচ্ছি এই জ্ঞান করা) আবশ্যক। সেটা প্রদান করার সময়ও হতে পারে বা যাকাতের সম্পদ হিসাব করে পৃথক করার সময়ও হতে পারে।
>> স্বর্ণ বা রৌপ্যের নেসাব পরিমাণ টাকা থাকলে তাতে ২.৫০% হারে যাকাত দিতে হবে।
>> প্রতিটা সম্পদের উপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। বরং, বছরের মাঝে যে সম্পদ অর্জিত হবে, তাতেও যাকাত আসবে।
>> মসজিদ-মাদ্রাসা বা রাস্তাঘাট নির্মাণে যাকাত দেয়া যাবে না। কারণ যাকাতের অর্থ ব্যয়ের শরীয়ত নির্ধারিত ৮টি খাতের মধ্যে তা পড়ে না।
>> যাকাত আদায়ের তারিখে যে যে সম্পদ থাকবে, সে সে সম্পদের যাকাত আদায় করবে।
>> যে মহিলাদের যাকাতযোগ্য অলংকার রয়েছে কিন্তু নিজস্ব উপার্জন বা নগদ অর্থ নেই, তাদেরকে নির্ধারিত পরিমাণ অলংকার অথবা তা বিক্রি করে হলেও সে অর্থ যাকাত হিসেবে দিতে হবে।
>> যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণে মনগড়া/অনুমাননির্ভর হিসাব করলে হবে না, বরং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে, যেন কোনো ক্রমেই পরিমাণের চেয়ে কম আদায় না হয়।
>> জমি, বাড়ি-ঘর, দালান, দোকান, কারখানা, যন্ত্রপাতি বা কাজের হাতিয়ার, অফিস ও ঘরের আসবাবপত্র-সরঞ্জামাদি, ব্যবহারিক যানবাহন ও চলাচলের পশু, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহপালিত পশু-পাখি ইত্যাদির যাকাত হয় না।
>> সোনা বা রূপার তৈরি গয়না, তৈজসপত্র, ফার্নিচার ইত্যাদির ওপর নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণ যাকাত ফরজ; তা ব্যবহারে থাকুক বা না থাকুক। তবে গয়নার ক্রয়মূল্য নয়, বিক্রয়মূল্যের ওপর যাকাত দিতে হবে।
>> যাকাত যেদিন হিসাব করে পৃথক করবে, সেদিনের মূল্য ধর্তব্য হবে।
>> ব্যবসার মালের ওপরও যাকাত ফরজ, যদি এর মূল্য সাড়ে ৭ তোলা সোনা বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপার সমান হয়। এছাড়া খামারে পালিত গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছ, পোনা, নার্সারির বীজ, চারা, হাউজিং ব্যবসার জমি, প্লট, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বা প্রাপ্ত বাড়ি-ভাড়ার ওপরও যাকাত দিতে হবে।
>> ব্যবসার দেনা (যেমন বাকিতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন/মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদি) পরিশোধিত না থাকলে সেই পরিমাণ অর্থ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
>> চন্দ্র মাস হিসাব করে যাকাত দিবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি বছর রমজানের বা মুহাররমের এক তারিখ যাকাত আদায় করবে।
>> অন্যের কাছ থেকে পাওনা টাকার ওপর যাকাত ফরজ, যদি দেনাদার তা স্বীকার করে এবং আদায়ের অঙ্গীকার করে অথবা নিজের কাছে তা উসুলের উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ থাকে।
>> যাকাতযোগ্য অলংকার রয়েছে কিন্তু নগদ অর্থ নেই, তাহলে যাকাত হিসেবে নির্ধারিত পরিমাণ অলংকার অথবা তা বিক্রি করে সেই অর্থ দিতে হবে।
>> স্ত্রীর মোহরের জমাকৃত টাকা এবং কোরবানির জন্যে জমাকৃত টাকার ওপরেও যাকাত দিতে হবে।
>> সরকারকে ট্যাক্স বা আয়কর দেয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করলে তাতে যাকাত আদায় হবে না। কারণ সরকার তা যাকাত হিসেবে বা শরীয়ত নির্ধারিত খাতেও ব্যয় করে না।
তথ্যসূত্র:
সামগ্রিক ভাবে পোষ্টটি লিখতে যেসব আর্টিকেল বিশেষভাবে সাহায্য করেছে:
>> যাকাত ও তার উপকারিতা – শেখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন [আরবী]
>> ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ণ – মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহা: ইয়াহয়া [বাংলা]
>> জাদীদ ফিকহী মাসায়েল – মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী [উর্দু]
>> এছাড়া বিভিন্ন ইংরেজি ফাতাওয়া ওয়েবসাইট যেমন: ইসলামওয়েব, ইসলাম অনলাইন, আস্ক ইমাম, দারুল ইফতা দেওবন্দ ইত্যাদি।

No comments :

Post a Comment