(গত ৫০ বছরে বিশ্বে সংঘটিত প্রধান যুদ্ধগুলোর গতি-প্রকৃতি ও এইসব যুদ্ধের নেপথ্যে থাকা আসল অপরাধী বা আসল সন্ত্রাসী চক্রগুলোর পরিচয় তুলে ধরার জন্য রেডিও তেহরানের এই বিশেষ আয়োজন)
মানুষের ইতিহাস যত প্রাচীন যুদ্ধের ইতিহাসও তত প্রাচীন। সত্য ও মিথ্যার কিংবা ন্যায় ও অন্যায়ের লড়াই সব যুগেই প্রচলিত ছিল। যুদ্ধের যে পক্ষ জালিম ও অন্যায্য লক্ষ্য পূরণের প্রত্যাশী সেই পক্ষ নীতি-নৈতিকতা, সত্য এবং মানবিকতার ধার ধারে না। কোনো কোনো যুদ্ধ বিশেষ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বা জাতির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন এনেছে।
আধুনিক যুগে অন্য অনেক কিছুর মত যুদ্ধের গতি-প্রকৃতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র। আধুনিক যুগের যুদ্ধে মানুষ ও জনপদ ধ্বংস হওয়া ছাড়াও ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। আধুনিক যুগের যুদ্ধের ফলে মানব-সম্পদের বাহ্যিক ক্ষয়ক্ষতি যেমন, হতাহত হওয়া, পঙ্গু হওয়া ও জটিল বা চিকিৎসাতীত নানা রোগের পাশাপাশি মনোস্তাত্ত্বিক ও মানসিক ক্ষতিও অত্যন্ত ব্যাপক এবং ধ্বংসাত্মক হচ্ছে।
যুদ্ধ ঠেকানোর পন্থা উদ্ভাবনের জন্য মানব সমাজ এ পর্যন্ত অনেক গবেষণা করেছে এবং গঠন করেছে জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা। কিন্তু যুদ্ধ থামানো বা ঠেকানো খুব একটা সম্ভব হয়নি। আর এর বড় কারণ হল বিশ্বশক্তিগুলোর কর্তৃত্বকামীতা, অবৈধ দখলদারিত্ব, অর্থনৈতিক শোষণ ও লুণ্ঠন, অস্ত্র-ব্যবসা ও ধ্বংসস্তুপ পুণর্গঠনের নামে আর্থিক ফায়দা হাসিল ইত্যাদি।
অথচ এই যুদ্ধবাজ ও সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোই নিজেদেরকে মানবাধিকারবাদী, শান্তিকামী, গণতন্ত্রকামী ও সন্ত্রাস-বিরোধী বলে জাহির করে থাকে। আর এইসব দাম্ভিক ও মুনাফিক শক্তিগুলোর শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমরা যদি গত ৫০ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, মার্কিন সরকার প্রকাশ্যেই নানা দেশ দখলের জন্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে অন্তত কুড়িবার। আর যুদ্ধের হুমকি তো অহরহই দিয়ে আসছে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নানা দেশের স্বাধীনচেতা ও মার্কিন নীতির বিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাও ছিল গত অর্ধশতকে মার্কিন সরকারগুলোর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অন্যতম জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সরকার ইউরোপের পুনর্গঠনের নামে সেখানকার অর্থনীতি ও শিল্প ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের পথ সুগম করে। এই সময়ের মধ্যে মার্কিন শিল্প সামগ্রী উন্নত অনেক দেশের শিল্প-সামগ্রীকে তাদের নিজ বাজারেই ম্লান করে দিতে সক্ষম হয়। আর এই অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের সুযোগে মার্কিন সরকার বিশ্বের রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অন্যদের চেয়ে বেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। বিশেষ করে বিশ্বে রাজনৈতিক মোড়লীপনা জোরদারের পথ এ সময়ই সুগম করে মার্কিন শাসকরা।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতা অর্জন ছিল মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপকামী নীতি জোরদারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এ যুগে মার্কিন স্বার্থের জন্য একমাত্র হুমকি বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে এ দুই পরাশক্তি জড়িয়ে পড়েছিল শীতল যুদ্ধে। আর বিশ্ব বিভক্ত হয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই ব্লকে। আমেরিকা তার মিত্র বা অধীন শক্তিগুলোকে নিয়ে গড়ে তোলে সামরিক-জোট ন্যাটো। এই জোট গঠনের সুবাদে মার্কিন সরকার উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে তার উপস্থিতি পাকাপোক্ত করে এবং কোরিয় উপদ্বীপেও জাতিসংঘের পুলিশ মোতায়েনের মাধ্যমে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির পথ প্রশস্ত হয়। এ ছাড়াও ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী দখলদারিত্বকে রাষ্ট্র হিসেবে বৈধতা দিয়ে মার্কিন সরকার মধ্যপ্রাচ্যেও তার উপস্থিতি পাকাপোক্ত করে। এরপর ৯০'র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে বিশ্বের নানা অঞ্চলে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ আরো বিস্তৃত হয়।
বেলজিয়ামের সাংবাদিক মিশেল ক্লুন 'শান্তির অক্ষ' বা 'অ্যাক্সিস ফর পিস' নামক বইয়ে গত ৫০ বছরের নানা যুদ্ধে মার্কিন ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন: 'মার্কিন সরকার নানা গণমাধ্যমের সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে যখনই যুদ্ধের আগুন জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছে, আর এ জন্য যত মিথ্যা প্রচারণা চালানো যায় তা চালিয়েছে সেইসব মিথ্যাচার প্রকাশিত হওয়ার ফলে পরবর্তীতে বার বার কলঙ্কিত হওয়া সত্ত্বে। আর এসবই করে যাচ্ছে তাদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধগুলোকে বৈধতা দেয়ার নামে।' এই লেখক মিথ্যা অজুহাতে চাপিয়ে দেয়া দশটি মার্কিন যুদ্ধের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। তার মতে এইসব যুদ্ধ হল: ভিয়েতনাম, গ্রানাডা ও পানামার যুদ্ধ, ইরাকের ওপর ১৯৯১ ও ২০০৩ সালের যুদ্ধ, ইয়োগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান এবং ভেনিজুয়েলা ও ইকুয়েডরের যুদ্ধ। গণমাধ্যমে যেসব অজুহাত দেখিয়ে এইসব যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পরবর্তীতে দেখা গেছে যে সেইসব তথ্য ছিল মিথ্যা এবং এইসব মিথ্যাচারের ফলে নিহত হয়েছে লাখ লাখ স্থানীয় বেসামরিক নাগরিক ও ঘটেছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ।
যেমন, মার্কিন সরকার বিভিন্ন সময়ে কখনও সন্ত্রাস দমন, কখনও মানবাধিকার রক্ষা ও কখনওবা রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের নামে চাপিয়ে দিয়েছে ধ্বংসাত্মক নানা যুদ্ধ। ফলে নানাভাবে বহু বছরের জন্য পিছিয়ে গেছে এইসব দেশের অগ্রগতি।
আমেরিকা ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার অজুহাতে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে হামলা চালায় আফগানিস্তানে। ২০০৩ সালেও গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের নামে মার্কিন হামলা হয় ইরাকে। অথচ মার্কিন সরকারই মধ্যপ্রাচ্যে আর আফগানিস্তানে সন্ত্রাস সৃষ্টি ও জোরদারে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। মূলত মার্কিন সরকারই ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য সাদ্দামকে প্রযুক্তি ও মালমশলা দিয়েছে।
মোটকথা এটা স্পস্ট যে, বিগত ৫০ বছরের যুদ্ধগুলোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই দায়ী এবং এর শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা। এই আলোচনার আগামী পর্বগুলোতে আমরা এইসব যুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আগামী পর্বে আমরা আলোচনা করব ভিয়েতনামের ওপর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের ভূমিকা নিয়ে। এ যুদ্ধের ফলে ইন্দোচীনের বিস্তৃত অঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে ও বিশ্ববাসীর যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনও পূরণ হবে না।
No comments :
Post a Comment