আসসালামু আলাইকুম

SSC পরিক্ষার্থীরা সুন্দরভাবে পরিক্ষা দিন এর জন্য আমি দোয়া করছি। সেই সাথে আমার ব্লগে ভিজিট করার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ।

Jan 30, 2015

'দুঃখীবুড়ি ও নেংটিইঁদুর

রংধনু আসরের শিশু কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আচ্ছা তোমরা কি বলতে পারবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ কোনটি? কী বললে- মা! তোমরা ঠিকই বলেছো। কেবল মধুর শব্দই নয় মা হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রিয় শব্দ।


মা-ই পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি তার সন্তানকে নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়েই যায় কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মা, সকল মমতার আঁধার ও কেন্দ্রবিন্দু। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে- পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায়ই 'মা'-এর সমার্থক শব্দটি 'ম' ধ্বনি দিয়ে শুরু হয়।   

মায়ের মর্যাদা দিতে গিয়ে রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন, জান্নাত মায়ের পদতলে। পিতার মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, পিতার সন্তুষ্টির ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টির ওপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নির্ভর করে।

বন্ধুরা, মাতা-পিতা দুজনই সন্তানের কাছে মর্যাদাবান হলেও ইসলামে মায়ের মর্যাদা পিতার চেয়েও বেশী দেয়া হয়েছে। কারণ সন্তানকে লালনপালন করার ক্ষেত্রে মা-ই বেশী ভূমিকা পালন করে থাকেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সন্তানের জন্মদাত্রী হিসেবে প্রাকৃতিকভাবেই মায়ের অবস্থান। মানব সমাজে যেমন মায়ের অবস্থান এক নম্বরে, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গের মধ্যেও প্রবল মাতৃত্ববোধ লক্ষ্য করা যায়।  আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প শোনাব। গল্পটি লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গল্পকার বিএম বরকতুল্লাহ। আর গল্প শেষে থাকবে এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। তাহলে প্রথমেই থাকছে আমাদের আজকের গল্প 'দুঃখীবুড়ি ও নেংটিইঁদুর'।

নদীপাড়ের গ্রাম দরগারবন। সেই গ্রামে বাস করে এক থুত্থুরে বুড়ি। তার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি, জমি-জিরাত সবই আছে। কিন্তু বিপদের সময় কিছুই তার কাজে লাগেনি। তার আছে চারটি ছেলে। এরা যেমন নির্দয় তেমনি লোভী ও স্বার্থপর। ছেলেরা বুড়ির যত্নআত্তি করবে তো দূরের কথা, দেখাশোনা পর্যন্ত করে না।

ছেলে ও ছেলের বউয়েরা উঠতে বসতে বুড়িকে অপয়া, অকর্মার ধাড়ি ইত্যাদি বলে গাল পাড়ে। তারা বুড়িকে উটকো ঝামেলা ও সংসারের অতিরিক্ত বোঝা মনে করে। এত অযত্ন অবহেলা আর কষ্টের মধ্যেও বুড়ি কেমনে কেমনে জানি বেঁচে আছে। আর তাতেই বাড়ির সবাই বুড়ির ওপর মহা বিরক্ত। 

বর্ষাকাল। প্রচণ্ড বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে রাস্তা-ঘাট ডুবে গেছে। চারদিকে থইথই করছে পানি। ঝড়ো হাওয়ায় কাঁপুনি উঠেছে বুড়ির। ঘরের কোণায় তাঁর পুরনো কাঁথা পড়ে আছে। বুড়ি হাত বাড়িয়ে কাঁথাটা ধরে টান দিতেই কাঁথার ভেতর থেকে অসংখ্য নেংটিইঁদুর বেরিয়ে চিকচাক করে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। বুড়ি কাঁথাটা তুলে ঝাড়া দিতেই টপাটপ মাটিতে পড়ল কতগুলো ইঁদুরছানা। এরা চিঁচিঁ চোঁচোঁ করতে লাগল। বুড়ি অসহায় ইঁদুরছানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরে কী মনে করে জানি কাঁথাটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিল। ঠাণ্ডা বাতাসে ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে লাগল বুড়ি।

ইঁদুরেরা ছোটাছুটি করে কোথাও পালাবার সুযোগ না পেয়ে বুড়ির কাছে ফিরে এসে বলল, ‘বুড়িমা, এই বন্যায় আমাদের আর কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই। তুমি যদি আমাদের তাড়িয়ে দাও তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমাদের মরতে হবে। সবাই আমাদের অপকারী প্রাণী মনে করে। কিন্তু সুযোগ পেলে আমরাও যদি তোমার কোনো উপকার করতে পারি!’

বুড়ি ইঁদুরকে বলে, ‘আমি তোমাদের তাড়িয়ে দেব না। তোমরা আমার সাথেই থাকবে এবং আমি যা খাই তোমরাও তা খাবে। আমার কাঁথা তোমাদের জন্য রইল। এখানেই তোমরা তোমাদের সন্তানদের নিয়ে বসবাস কর। আর মনে রেখ, আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না।’

এ কথা শুনে ইঁদুরেরা আনন্দে বুড়ির কাছে এসে নাচানাচি করতে লাগল। তারা বুড়িকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মনের সুখে কাঁথায় আশ্রয় নিল।

একদিন হলো কি, একটা বিড়াল এসে বুড়ির ঘরে ঢুকে খপ্ করে একটা ইঁদুর ধরে ফেলে। ইঁদুরের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বুড়ি হাতের লাঠি দিয়ে দিল এক বাড়ি। লাঠির আঘাতে বিড়ালের একটি পা ভেঙে গেল। বিড়ালটি মুখের ইঁদুর ফেলে মিঁ-ঞা-ও, মিঁ-ঞা-ও করে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে গিয়ে ঘরে উঠল। আদরের পোষা বিড়ালের এ দুরবস্থা দেখে বাড়ির সবাই রেগে আগুন হয়ে গেল এবং ছেলেরা বুড়ির প্রতি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ছেলেরা পরামর্শ করে বুড়িকে বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত নিল। কেননা এ বাড়িতে বুড়ির মূল্য-মর্যাদা বিড়ালের একটা ঠ্যাং এর চেয়েও অনেক কম।

ছেলেরা বুড়ির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বড় ছেলে আহত বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে,‘এই যে বিড়ালটা দেখছ, সে আমাদের অনেক উপকার করে। আর তুমি আমাদের এই প্রিয় বিড়ালটিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে। আবার কখন যে তুমি আমাদের শিশু-সন্তানদের ওপর চড়াও হয়ে কোন অঘটন ঘটাও তা কে জানে! আমাদের ঘামঝরা অন্ন দিয়ে তোমাকে আর পোষতে পারব না। নির্বাসনে দেব তোমাকে।’

যেই কথা সেই কাজ। বাড়ির সাথেই খরস্রোতা নদী; তারপর গহীন বন। ছেলেরা নদী পাড়ি দিয়ে সেই বনে বুড়িকে নির্বাসনে দিয়ে এল। বুড়ি যাওয়ার সময় তার ঘরে যা যা ছিল তা নিয়ে গেল। তার কাঁথার ভেতরে ছিল নেংটিইঁদুরগুলো। বুড়ির সাথে এরাও নির্বাসিত হল।

অচেনা বন। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে সবার। নেংটিইঁদূরেরা বুড়ির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আর সহ্য করতে পারল না। তারা খাবারের সন্ধানে চারিদিকে বেরিয়ে গেল। ক্ষুধার্ত বুড়ি গাছতলায় বসে ঝিমূতে লাগল।

ইঁদুরেরা গহীন বনের ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে খাবারের সন্ধানে ঘুরতে লাগল। কোথাও কোন খাবার পাওয়া গেল না। তারা সামনে যাকে পেল তার কাছেই বুড়ির দুঃখের কথা বলল।

‘আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে এক অসহায় দুখীবুড়ি বনে নির্বাসিত হয়েছেন। আমাদের বিপদের দিনে নিজে উপোস করে আমাদের খাইয়েছেন। আমরা তাঁর দয়ায় কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। সেই বুড়ি আজ ক্ষুধার্ত। তোমরা এই দয়ালুবুড়ির জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দাও না ভাই।‘

ইঁদুরের মুখে বুড়ির দয়ার কাহিনী শুনে বনের পশু-পাখিরা বলল, ‘বুড়ি যদি সত্যি সত্যি দয়ালু হয়ে থাকে আর তোমাদের উপকার করে থাকে তবে তাঁর জন্য কোনো চিন্তা কর না তোমরা। এ বনে তাকে না খেয়ে মরতে দেব না।’

সন্ধ্যা হয় হয়। বুড়ি ক্ষুধার জ্বালায় ছট্ফট্ করছে। ইঁদুরছানাগুলোও চিঁচিঁ করছে। বুড়ি মনে মনে ভাবছে, তাকে বনের ভেতরে একা ফেলে রেখে এতক্ষণে নেংটিইঁদুরগুলো যার যার মত পালিয়ে গেছে।

হঠাৎ বুড়ির সামনে একটা বানর এসে উঁকি দিল। তারপর চারদিক থেকে আসতে লাগল বাঘ, ভালুক, বনগরু, গাধা, শিয়াল, কাঠবেড়ালী। এসব ভয়ংকর প্রাণী দেখে ভয়ে বুড়ির শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বুড়ির আর বুঝতে বাকি রইল না যে, এখনই তার এই পশুদের পেটে যেতে হবে। ওরা এখনই তাকে টেনে হিঁচড়ে খেয়ে ফেলবে। পশুরা দেখল, বুড়ি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। তারা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে নরম সুরে বুড়িকে বলল, ‘হে দয়ালুবুড়ি, তুমি আমাদের দেখে ভয় পেও না। আমরা তোমাকে খেতে আসিনি- খাওয়াতে এসেছি। তুমি যে কত মহৎ আর দয়ালু তা আমরা নেংটির কাছ থেকে শুনেছি। তোমার সেবা যত্ন করে আমরা ধন্য হতে চাই।

পশুদের কথায় বুড়ি অবাক হয়ে বলল, ‘একি বলছ, তোমরা তো হিংস্র প্রাণী!’
পশুরা জবাব দিল, ‘হিংস্রতা আমাদের ধর্ম নয়। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের হিংস্র হতে হয়। আমাদের চেয়েও হিংস্রপ্রাণী মানুষ। এ বনে ক্ষুধা না পেলে কেউ কাউকে অনর্থক বধ করে না কিন্তু মানুষ এতোই হিংস্র যে, তারা মনের আনন্দে বিনা কারণে আমাদের নির্মমভাবে হত্যা করে, আমাদের ধরে খাঁচায় বন্দী করে আনন্দ উপভোগ করে। তাদের সামান্য আনন্দের জন্য আমাদের কত জীবন যে বিসর্জন করতে হয়! কিন্তু তুমি তো শুধু মানুষই নও, তুমি মহান এবং আমাদের বন্ধু। তুমি ক্ষুদ্রপ্রাণী নেংটিইঁদুরের প্রতি যে দয়া করেছ তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে।’

এই বলে যে যা এনেছে তা বুড়ির সামনে এনে রাখল। নানা জাতের ফল, শবজি, মাছ, মাংস ও ডিমের  স্তূপ পড়ে গেল বুড়ির সামনে। বুড়ির চক্ষু ছানাবড়া। খাবে আর কতো!
পশুরা বলে, ‘তুমি হতাশ হয়ো না। আমরা প্রতিদিন তোমাকে খাবার এনে দেব। তোমাকে এই বনে কোনো কষ্ট করতে দেব না আমরা।

বুড়ি বনের ফলমূল, মাছ-মাংস, মধু, ডিম ইত্যাদি খেয়ে সবল হয়ে উঠল। সে বন জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যায় সেখানেই তার কদর। বুড়ির ও ইঁদুরের আর কোনো কষ্ট রইল না, তাদের মহানন্দে দিন কাটতে লাগল।

এদিকে, বুড়ির ছেলেমেয়েরা পড়েছে বিপাকে। নদীভাঙ্গনে তাদের ঘরবাড়ি, জমি-জমা বিলীন হয়ে গেছে। তারা এখন নিঃস্ব। এদের খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এরা ছেলেমেয়ে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যাবে কোনো উপায় করতে না পেয়ে ওরা ঘুরে ফিরে সেই বনে গিয়ে উঠল যেই বনে একদিন ওদের মাকে নির্বাসন দিয়েছিল।

ছেলেরা ঘুরতে ঘুরতে বনের ভেতরে মাকে পেয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘মা, তোমার প্রতি আমরা অনেক অন্যায় অবিচার করেছি, আমরা পাপী। তোমাকে নির্বাসনে দেয়ার পর থেকে আমরা একটি দিনও সুখে-শান্তিতে থাকতে পারিনি। একটা না একটা বিপদ লেগেই আছে। আমরা সবকিছু হারিয়ে পথের কাঙ্গাল হয়ে গেলাম। আমরা এখানে সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে চাই। তুমি আমাদের দয়া করে এ বনে একটু আশ্রয় দাও মা।

সব শুনে মা অনুতপ্ত ছেলেদের দয়া করলেন।
এমন সময় একটা নেংটিইঁদুর তেড়েমেড়ে এসে বুড়ির বড় ছেলেকে লক্ষ্য করে বলে, ‘এই দুষ্টু বেটা, তোমার সেই ফাজিল বিলাইটা কই, যে আমাকে খপ্ করে ধরে খেয়ে ফেলতে চেয়েছিল? তাকে যদি সাথে করে এনে থাক তবে ভালোয় ভালোয় বের করে দাও, খামচিতে তার ছাল তুলে ফেলব’ –

এই বলে নেংটিইঁদুর রাগে কাঁপতে লাগল। নেংটির কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে পারল না কেউ।
এর পর ছেলেরা বউ বাচ্চাদের নিয়ে বনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

বন্ধুরা দেখলেতো, এতবড় অন্যায় করার পরও মা কিভাবে তার সন্তানদের ক্ষমা করে দিলেন! আসলে মায়েরা এমনই। আর এ কারণেই তাদের মর্যাদা সবার উপর।

No comments :

Post a Comment