আসসালামু আলাইকুম

SSC পরিক্ষার্থীরা সুন্দরভাবে পরিক্ষা দিন এর জন্য আমি দোয়া করছি। সেই সাথে আমার ব্লগে ভিজিট করার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ।

Feb 10, 2015

যুদ্ধ, সমঝোতা এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা

লিখেছেনঃ জামালউদ্দিন বারী :
‘দেশের কি অবস্থা? কোথায় যাচ্ছে দেশ? দুই নেত্রীর সমঝোতা হবে তো? পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি কি পারবে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে? গত এক মাস ধরেই তো বলা হচ্ছে, এক সপ্তায় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। হচ্ছে না তো। বরং সহিংসতা বেড়েই চলেছে! দেশটা তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা আসলে কোন দিকে?’ বাইরে বেরোলেই ইদানীং এমনসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পরিচিতজনদের এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া মুশকিল। কোন প্রিডিকশনই আর কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তবে প্রত্যেকেই যার যার রাজনৈতিক পরিচয় ও পছন্দ অনুসারে যুতসই জবাব ও সমাধান খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হিসেবে  যা ধরা পড়ছে, তা হচ্ছে, বেশিরভাগ অতি সাধারণ, স্বল্পশিক্ষিত ও নিম্নবিত্তশ্রেণীর মানুষও সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ বা টকশো দ্বারা তেমন প্রভাবিত হচ্ছে না। পত্রিকা এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিকানা, রাজনৈতিক অবস্থান এবং সাধারন এজেন্ডা সম্পর্কে পাঠক ও দর্শকরা যেন আগেই তাদের ধারণা  তৈরি করে রেখেছে। বাড়তি খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এমনকি বিশেষ কলামিস্ট অথবা টকশোর টকারের রাজনৈতিক সমর্থন, ব্যক্তিগত-পারিবারিক অবস্থান ও ঠিকুজি যেন তাদের নখদর্পণে। ছোট্ট টং দোকান থেকে শুরু করে হোটেল বা হাসপাতালের ওয়েটিং লাউঞ্জ পর্যন্ত সবখানেই স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ সর্বক্ষণ একটা না একটা টিভি খোলা থাকতে দেখা যায়। বিরোধী জোটের অবরোধ-হরতাল, বাসে পেট্রলবোমার আতঙ্ক, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ইত্যাদি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনুসঙ্গের সাথে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ব্যাপক পরিণত হয়েছে। বাস্তবতা এড়িয়ে মতলববাজ, একচোখা বা দলকানা ব্যক্তিদের লেখা বা টকশোর প্যাঁচাল শুনে সময় নষ্ট করতে যেন অনেক দর্শক-পাঠকই রাজি নয়। রেখেই রিমোটের নব ঘুরিয়ে চলেছেন। শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানে ভিন্নতা থাকলেও মতামত গ্রহণ ও বর্জনের পেছনে প্রত্যেকের দেশাত্মবোধ, বিবেক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ এক ধরনের সেন্সরশিপ আরোপ করছে। এভাবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই কর্পোরেট মিডিয়ার প্রোপাগা-া এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডার অলআউট প্রোগ্রামের মধ্যে যে নতুন জনমত গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে তাকে এক অর্থে কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ বলা যায়। জনমত গঠনে মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বটে, তবে তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রোপাগা-া কাজে লাগলেও জনমত গঠনে তা আদতে বিপরীত ফলই বয়ে আনছে। ওয়ার অন টেররিজম শুরু করতে নাইন-ইলেভেনের মতো সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে আল-কায়েদার নাম সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে পশ্চিমা দুনিয়ায় আল-কায়েদা আতঙ্ক বা আল-কায়েদাবিরোধী মনোভাব গঠনের পাশাপাশি ইহুদি জায়নবাদ প্রভাবিত মার্কিন নিওকন রাজনীতিকরা পশ্চিমাবিশ্বে মুসলিমবিদ্ধেষ তথা ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর গড়িয়ে যুদ্ধের বিভীষিকা যতই বেড়েছে, যুদ্ধে বিজয়লাভের সম্ভাবনা ততই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একসময় দেখা গেল, পশ্চিমাবিশ্বের খ্রিস্টানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে কৌতুহল বেড়েছে, মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিও বেড়েছে। পরে দেখা গেল, পশ্চিমাবিশ্বে কনভার্টেড মুসলমানের সংখ্যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। সেই সাথে এন্টি জায়নিজম এবং এন্টিসেমিটিজমের মাত্রাও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে তুঙ্গে উঠেছে। দশকব্যাপী অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের বিমান হামলা, স্থল অভিযান, গণহত্যা, নতুন বসতি নির্মাণ ও ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পশ্চিমা মেইনস্ট্রিম ও কর্পোরেট মিডিয়াগুলো একচোখা নীতি গ্রহণ করার পরও সারাবিশ্বে ইসরাইলবিরোধী জনমত গঠনে ভূমিকা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। 
দুই.
২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকাল রাজপথ অবরোধের ৩৫ দিন অতিক্রম করেছে। পাশাপাশি দু’এক দিনের বিরতির পর পর চলছে লাগাতার হরতাল। গত সপ্তায় ব্যবসায়ীদের দেয়া এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, একমাসের অবরোধে দেশের অর্থনীতিতে ৭৪ হাজার কোটির টাকার ক্ষতি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অবরোধ-হরতাল মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। দেশের এলিট ফোর্স ও পুলিশ বাহিনীকে প্রধানত বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি দমন ও ধরপাকড়ে লাগিয়ে রাখার পাশাপাশি সারাদেশে শত শত প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করেও হরতাল-অবরোধের আড়ালে পেট্রলবোমার নাশকতায় পুড়িয়ে মারার নৃসংশতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব বাহিনীর প্রধানরা দেখামাত্র গুলির হুমকি  দিয়ে গত ৩৫ দিনে কয়েক দফায় ৭ দিনের মধ্যেই সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাশকতাকারীদের বংশসুদ্ধ ধ্বংস করে দেয়ার কথাও বলেছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নাশকতা দমনে পুলিশকে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজের উপর উপর দায়িত্ব নিয়ে পুলিশকে যে কোন কিছু করার এক ধরনের ব্লাঙ্ক-চেক দেয়ার পর থেকে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেড়ে গেছে। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নষ্ট করে সরকারের দলীয় বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অভিযোগ উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা, পাইকারি ধরপাকড়, জামিন না-মঞ্জুর, রিমান্ডে নিয়ে যথেচ্ছ নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনা বিচারবিভাগের উপর সরকারি প্রভাবের প্রতিফলন হিসেবে ব্যাখ্যাত হতে পারে। এরপরও বন্দুকযুদ্ধের নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রায় প্রতিদিনই বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা নিহত হচ্ছে। দেশের একজন মানবাধিকার কর্মী গত শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নাশকতা দমন বা সঙ্কট নিরসনে পদক্ষেপের নামে সরকারের নির্দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে, ট্রাক চাপাসহ নানাভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রতিদিনই মানুষ মরছে। এসব ঘটনাকে তিনি বিচার বিভাগের উপর সরকারের আস্থাহীনতা বলে অভিহিত করেছেন। 
বিচার বিভাগ ও আইনের শাসনের প্রতি ‘সরকারের আস্থাহীনতা’র অভিযোগ যে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থায় 
একটি মারাত্মক রাজনৈতিক উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। আমরা বলছি, জনগণ সর্বোচ্চ ক্ষমতার 
উৎস ও অধিকারী। আর জনগণের এই ক্ষমতাকে ধারণ করে রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত। সরকার রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের সাংগঠনিক কাঠামোর একটি অংশ মাত্র। সরকার বা নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর অযাচিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে তার আইনি ভিত্তি থেকে বিচ্যুত করার মাধ্যমে দুর্বল করে দিতে পারে। সে ধরনের অবস্থায় জনগণ সুশাসনবঞ্চিত হয়। আইনের শাসন বাধাগ্রস্ত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের আইন বিভাগ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আইনের যথেচ্ছ পরিবর্তন ও বলবৎকরণের উদ্যোগ নিয়ে পুরো আইনি ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে। এখনো আমরা বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হিসেবে মনে করছি। কোন রাজনৈতিক দল সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর সংবিধান পরিবর্তনের আইনগত শক্তি অর্জন করতে পারে। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এবং রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীকে দিয়ে সরকার দেশে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে দমন বা নির্মূলের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশে যে পরিস্থিতি হতে পারে বর্তমানে বাংলাদেশে সেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশ্বের আরো অনেক দেশেই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও একাধিকবার এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার নজির রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত জনগণের ইচ্ছা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী শাসকের পতন ঘটেছে। শুধু সরকার নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলও তাদের দিক থেকে স্বৈরাচারী-স্বেচ্ছাচারী হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জনগণের রায়ের কোন ব্যতিক্রম ঘটে না। মুক্তিকামী জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। দেশের সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে অযাচিত বিদেশি হস্তক্ষেপ অথবা অন্য কোনভাবে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মানবাধিকার নস্যাৎ হওয়ার উপক্রম হলে জনগণের সাধারণ ইচ্ছায় গণপ্রতিরোধ বা গণবিষ্ফোরণে রাজনৈতিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। 
তিন.
ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলো নিয়ে পরাশক্তিগুলোর জিও-স্ট্রাটেজিক এজেন্ডা কোন নতুন বিষয় নয়। গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র এ ক্ষেত্রে কোন মুখ্য বিষয় নয়। গণতন্ত্রকে নিজেদের মতো করে বাস্তবায়ন করতে না পারলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের এজেন্ডা বাস্তবতায়ন সম্ভব নয়। এ কারণে প্রধানত মুসলিম বিশ্বে তারা গণতন্ত্রের চেয়ে রাজতন্ত্র বা সামরিক একনায়কত্বকেই বেশি উৎসাহিত করে থাকে। মিশর বা পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা মার্কিনীদের বশংবদ হয়ে কাজ করে বিধায় তাদের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থনের কোন ঘাটতি কখনো দেখা যায়নি। পক্ষান্তরে মিয়ানমার বা উত্তর কোরিয়ার শাসকরা ভিন্নমতের হওয়ায় সেখানে গণতন্ত্র না থাকাকে অসহযোগিতা ও নিষেধাজ্ঞার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভেদে পরাশক্তিগুলোর হিসাব-নিকাশ ও ভোল পাল্টে যেতেও দেখা যায়। কখনো কখনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাগ্য পরাশক্তি ও তাদের আঞ্চলিক অংশীদারদের মধ্যকার বোঝাপড়ায় দাবার গুটির মতো ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত-মার্কিন বোঝাপড়া অথবা মতপার্থক্য সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে একটি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হতে দেখা যাচ্ছে। এ আলোচনা এখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশিদের অপ্রকাশ্য বোঝাপড়াকে এদেশের মানুষ কখনো ভালো চোখে দেখে না। এটা আমাদের জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধকে আঘাত করে। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এদেশের জনগণের ইচ্ছায়ই শুধু পরিচালিত হবে, অন্য কোন দেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের দাবার গুটি হিসেবে নয়। দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি স্রেফ নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে অথবা ক্ষমতা লাভ করতে জনগণের ইচ্ছা ও সমর্থনকে অগ্রাহ্য করে সেসব শক্তির ইচ্ছায় পরিচালিত হয় তাহলে জনবিচ্ছিন্ন ও পাপেট শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে। ষোলকোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ যখন রাজনৈতিক সহিংসতা ও নাশকতার আগুনে পুড়ছে, বিশ্বসম্প্রদায়ের চোখ তখন প্রধানত পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের দিকে নিবদ্ধ। গত এক বছর ধরে বিশ্বশক্তিগুলো ইউক্রেন নিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক খেলায় মত্ত রয়েছে। একদিকে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষার এই খেলা শেষ পর্যন্ত একটি ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন। ইউক্রেনের পুতুল সরকারের প্রধানমন্ত্রী পেরোশেঙ্কোর পাশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ন্যাটো জোটসহ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গেরিলাদের সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া। পাশাপাশি কিয়েভের উপর সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের হুঁশিয়ারিও জারি রেখেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের সংঘাতে গত একবছরে অন্তত ৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সারা ইউরোপ ও আমেরিকার সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে পেরোশেঙ্কোর পুতুল সরকার ইউক্রেনের অখ-তা অথবা নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। অন্যদিকে একটি বৃহৎ যুদ্ধে জড়িয়ে রাশিয়ারও তার অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাক্রমকে অক্ষুণœ রাখার বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়া স্বাভাবিক। একইভাবে রাশিয়ার আঞ্চলিক স্বার্থের উপর হস্তক্ষেপ করে ইউরোপ-আমেরিকা একটি নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কতটা লাভবান হবে সে হিসাব-নিকাশও চলছে। তবে উভয় পক্ষেই একদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও সাজ সাজ রব শোনা যাচ্ছে, অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে চলছে সংলাপ ও সমঝোতার শেষ চেষ্টা। এ সপ্তায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওঁলাদ এবং জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল মস্কো গিয়ে পুতিনের সাথে দেখা করে কথাবার্তা বলে সঙ্কটের বরফ কিছুটা গলাতে সক্ষম হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। সামরিক আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এলাকায় সরকারি বাহিনীর অভিযান এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করার শর্ত দিয়েছেন পুতিন। পক্ষান্তরে কিয়েভের পেরোশেঙ্কো সরকার বিদ্রোহীদের কার্যক্রম বন্ধের শর্ত দিয়েছেন। ন্যাটো বাহিনী তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে রাশিয়াকে কাবু করার সামর্থ্য রাখে বলে দাবি করলেও এই যুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো জড়িয়ে পড়ার কারণে এটি একটি বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়ার আশঙ্কা প্রবল। তবে মার্কেল ও ওঁলাদের মতো ইউরোপীয় নেতারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটি আপসরফার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ইউরোপের ইচ্ছা ও বাস্তবতার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতভিন্নতা নিরসনেরও চেষ্টা করছেন। মার্কিনীদের চাপ সত্ত্বেও ইউক্রেন সরকারকে সমরাস্ত্র সরবরাহ করা থেকে বিরত থেকে জার্মানি রাশিয়ার সাথে মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রেখেছে। ১১ জানুয়ারি বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে রাশিয়া, ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি চারপক্ষীয় সমঝোতা বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তাদের কূটনৈতিক উদ্যোগ ইউরেশিয়া অঞ্চলকে একটি বড় ধরনের সংঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে। 
চার.
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা ও অচলাবস্থা নিরসন করে জনগণের কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক সহাবস্থান ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের রূপরেখা প্রণয়নে ইতিপূর্বে দেশি-বিদেশি উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেও গত বছরের ৫ জানুয়ারির একপাক্ষিক নির্বাচন স্থগিত রেখে সমঝোতার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুতে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে পারেননি। মূলত ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের অনড় অবস্থানের কারণেই সেটি সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের আগে কয়েক মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। আগেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত তার বাজার হারাতে শুরু করেছিল। গত এক বছরেও কোন রাজনৈতিক সমঝোতা বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোন উদ্যোগ না থাকায় নতুন বছরের শুরু থেকে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির আড়ালে যে সহিংসতা ও জ্বালাও-পোড়াও নাশকতা চলছে, গত একমাসে তার ফলে আমাদের অর্থনীতিতে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতসহ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ধস নেমেছে। অ্যাপারেল রফতানিতে গত একদশক ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশের অবস্থান ইতোমধ্যেই ভারতের কাছে হাতছাড়া হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে ভারতে রেমিটেন্স প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এহেন বাস্তবতায়, এ দেশের সাধারণ মানুষ যদি মনে করে, বাংলাদেশকে একটি সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে  কেউ ফায়দা নিতে চাচ্ছে তা অযৌক্তিক হবে কি? অবশ্য তা যদি সত্যি হয়, এর জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাই দায়ী। তারাই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর হাতে এ ধরনের সুযোগ তুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন নাকি ভারতের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। তবে বাংলাদেশের জনগণ বড় প্রতিবেশী ভারতের সাথে সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যাশা করে। পানিচুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, সীমান্তে হত্যাকা- বন্ধসহ দ্বিপাক্ষিক সকল সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান চায়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করে আইনের শাসন, মানবাধিকার রক্ষা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে কার্যকর উদ্যোগ তথা রাজনৈতিক সমঝোতা প্রত্যাশা করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
bari_Zamal@yahoo.com

No comments :

Post a Comment